আজ ১৬ মে, ২০২৪, বৃহষ্পতিবার, সকাল ১১:৩০ মিনিটে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ এর উদ্যোগে ইউএসএইড এবং কাউন্টারপার্ট ইন্টারন্যাশনালের এর সহযোগিতায় ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে “নদী দূষণ বন্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা”শীর্ষক নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল এর সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই সংলাপে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার। সংলাপে বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন খুলনার সাবেক সংসদ সদস্য (সংরক্ষিত নারী আসন) অ্যাডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার, এবং সাবেক সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী।
নাগরিক সংলাপে প্যানেল আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) এর প্রশিক্ষণ কো-অর্ডিনেটর জিলহাস উদ্দিন নিপুন, বাংলাদেশ ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট (বিএফইউজে) এর কোষাধ্যক্ষ এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর সিনিয়র রিপোর্টার খায়রুজ্জামান কামাল, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মিডিয়া বিভাগের প্রধান মোস্তফা আলমগীর রতন, দ্য ডেইলি স্টার এর চিফ রিপোর্টার পিনাকী রায়, একাত্তর টেলিভিশনের অ্যাসোসিয়েট চিফ নিউজ এডিটর মো: আহসান হাবীব পলাশ, ঝটিকা সফরের প্রধান নির্বাহী এবং ইরাবতী ইকো রিসোর্টের পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌসী মানু, দৈনিক কালের কন্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার নিখিল চন্দ্র ভদ্র, নেক্সাস টেলিভিশনের এডিটর কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স আমিন আল রশিদ, এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন এর বিরবেক স্কুল অব ল’ এর সহযোগী প্রভাষক মোহাম্মদ গোলাম সারওয়ার প্রমূখ। এসময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেন রিভার বাংলা সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ। এছাড়াও সংলাপে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ এবং বালু নদী পাড়ের ভূক্তভোগী মানুষদের প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।
প্রধান অতিথির আলোচনায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, আমাদের স্বাধীনতার শ্লোগান ছিল, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। সেই পদ্মা, মেঘনা, যমুনাকে বাঁচাতে কাজ করতে গেলে আজকে হুমকি আসে। সেসকল হুমকিকে মোকবেলা করার সক্ষমতা আপনারা গণমাধ্যম কর্মীবৃন্দ দেখিয়েছেন। গণমাধ্যমে রিপোর্ট আসছে। অনেক কোয়ালিটি রিপোর্ট হয় তবে সর্বপরি রিপোর্টের কোয়ালিটি আরো বাড়াতে হবে। নদীর আইন কেন প্রয়োগ হচ্ছে না তা নিয়ে কথা বলার সময় হয়েছে। নদী হলো পাবলিক প্রপার্টি। এটাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।
সভাপতির আলোচনায় শরীফ জামিল বলেন, নদীমাতৃক দেশের মানুষ হিসাবে আমাদেরকে নদীকে জানতে হবে। নদী কাকে বলে সেটা আইনে বলা আছে। ইংল্যান্ডের মানুষ টেমস নদীকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে বাঁচিয়ে তুলেছে। আমাদের দূষিত নদীগুলোকে আমরা হয়তো একদিন দূষণমুক্ত করতে পারবো। তবে ঢাকার নদীগুলো অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। আর সে জনু কিন্তু তার জন্য নদীকেও তো বেঁচে থাকতে হবে। দখলদাররা নিয়মিতভাবে দখল করে নিচ্ছে সব নদী। নদী থেকে সকল দখলদারদেরকে উচ্ছেদ করতে হবে। ইটিপি স্থাপনের মাধ্যমে কারখানার দূষিত বর্জ্যকে পরিশোধনের মাধ্যমে দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো যদি আমরা রক্ষা করতে না পারি তাহলে বাংলাদেশকে বাঁচাতে পারবো না।
গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার বলেন, একসময় আমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে শহরে আসতে ৩ টি নদী পাড়ি দিতে হতো। প্রকৃতি ছিল আমাদের জীবনের অংশ। আজকে আমরা উন্নত হয়েছি কিন্তু হারিয়েছে আমাদের প্রকৃতি। যে সুন্দরবন আমাদেরকে মায়ের মতো আঁচল দিয়ে ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করে সেই সুন্দরবনকে আমরা ধ্বংস করছি ভেতর থেকে। নদীর চর দখল হয়ে যাচ্ছে। নদীর জন্য অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে সরকার কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না। প্রধানমন্ত্রী পরিবেশপ্রেমী মানুষ, বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে তার কাছে তথ্য প্রদান করতে হবে। তাহলেই আমরা নদী-পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে পারবো। নদীকে বাঁচাতে পারবো।
শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, নদীকে বাঁচানোটা হলো আমাদের ক্রায়িং নিড। নদী রক্ষায় আমাদের অবস্থা হলো তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠা সেই বানরের অঙ্কের মতো। আমরা এক হাত উঠি তো দুই হাত নামি। নদীর প্রতি অবহেলা সংশোধনের অযোগ্য। নদী বিষয়ে কাজ করবার জন্য নদী গবেষণায় আর্থিক অনুদান এবং প্রণোদনা প্রদান করতে হবে। নদীকে সর্বত্র আলোচনায় আনতে হবে। নদী নিয়ে যে সকল গণমাধ্যম কর্মীরা কাজ করেন তাদেরকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্র প্রণোদনা প্রদান করতে পারে গণমাধ্যমগুলোকে।
খায়রুজ্জামান কামাল বলেন, গণমাধ্যমের কর্পোরেট মালিকানার ফলে অনেক সংবাদই প্রকাশিত হয় না। গণমাধ্যম কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তাদেরকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। সারাদেশের সকল গণমাধ্যম কর্মীদেরকে নিয়ে আমাদেরকে একসাথে কাজ করতে হবে দেশের নদীগুলোকে তথা দেশকে বাঁচাতে হলে।
জিলহাস উদ্দিন নিপুন বলেন, সাংবাদিকরা রিপোর্ট লিখেন কিন্তু অনেক সময়ই তা প্রকাশিত হয় না। নদীর কষ্টে যদি আপনি কষ্ট না পান তবে বুঝতে হবে আপনার ভেতরে দেশপ্রেম নেই।
মোস্তফা আলমগীর রতন বলেন, পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণের কারণে আমাদের সর্বাঙ্গে ব্যাথা, ওষুধ দেবো কোথা অবস্থা হয়ে গেছে। দেশে নদীর সংখ্যা কত, দূষণে কি অবস্থা, কোথায় দখল হচ্ছে এই খবরগুলো আমরা গণমাধ্যমের মাধ্যমেই জানতে পারি। অনেকসময় অনেক খবর বাধাগ্রস্ত হয়। আমাদের সকলকে এসব বিষয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে
জান্নাতুল ফেরদৌসী মানু বলেন, আমাদের নদীকে বাঁচাতে হলে বেশি বেশি নির্ভীক ও মানসম্মত রিপোর্ট দরকার। নয়তো আমাদের নদীগুলোকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।
আমিন আল রশিদ বলেন, আমাদের মাথার ভেতরে নদীটা থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত নদী ও পরিবেশ বাঁচাতে তাগিদ দিচ্ছেন কিন্তু তারপরও দুষণ-দখল বন্ধ হচ্ছে না। নদী আমাদের মা, কিন্তু দিনশেষে আমরা আমাদের মা-কেই মেরে ফেলছি। নদী আইন বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদেরকে সততা এবং নির্ভীকতার পরিচয় দিতে হবে।
পিনাকী রায় বলেন, বালু নদী রক্ষায় বারোগ্রামের যে আন্দোলন ছিল তার রিপোর্ট আমি করেছিলাম। নদী নিয়ে আমি সর্বশেষ যে প্রতিবেদনটি করেছি তাতে তথ্য ছিল যে, দেশের মোট ৫৬ টি নদী দূষিত। আদতে তা হয়তো আরো বেশি হবে। কিন্তু আমাদের হাতে সঠিক ডাটা নেই। নদী নিয়ে আগের তুলনায় মিডিয়াতে রিপোর্টের সংখ্যা বাড়ছে আর বাড়ছে নদী দূষণের পরিমাণও। দেশে আইন আছে কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন নেই। প্রধানমন্ত্রী নদী রক্ষার কথা বলেন। নদী রক্ষায় বরাদ্দ হয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু সেই টাকার বেশিরভাগ খরচ হয়েছে ল্যান্ডিং স্টেশন তৈরি করতে, ওয়াকওয়ে নির্মাণে। সরকার অবকাঠামো করছে কিন্তু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আমাদের দেশে জার্নালিজম নিয়ে যেসকল প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হয় তাতে পরিবেশ সাংবাদিকতার বিষয়ে শেখানো হয় না। পরিবেশ সংক্রান্ত সরকারি দপ্তর থেকে নদী দূষণের ডাটা পাওয়া যায় না।
মো: আহসান হাবীব পলাশ বলেন, নদী নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক রিপোর্টই হয়, কিন্তু ভালো এবং মানসম্মত রিপোর্টের পরিমাণ কম। নদীপাড় থেকে রিপোর্ট আসতে হবে। নদীকে নিয়ে রিপোর্ট করতে নদীর কাছে যেতে হবে। ভালো রিপোর্টের জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে আমাদেরকে। এই দেশেরইতো গণমাধ্যম, দেশের স্বার্থেই নদী রক্ষায় কাজ করতে হবে গণমাধ্যমকে।
নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পরে আমরা সুন্দরবন ও উপকূল রক্ষায় আন্দোলন শুরু করি। উপকূলের নদ-নদীগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। সমস্যা সঙ্কুল অবস্থার মধ্যে আছে উপকূলের নদীপাড়ের মানুষেরা। গণমাধ্যমের সাথে থেকে আমরা কাজ করতে চাই।
বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চার নেতা, নিরাপদ চিকিৎসা চাই এর সাধারণ সম্পাদক উম্মে সালমা, আমাদের নদী দূষিত। বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের কাজ না করে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হচ্ছে। ওয়াকওয়ে করা হচ্ছে, গাছ লাগানো হচ্ছে কিন্তু সারা ঢাকার যত বর্জ্য সব বুড়িগঙ্গার পানিতেই ফেলা হচ্ছে। পলিথিনে ভরে যাচ্ছে আমাদের বুড়িগঙ্গা।
বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চার নেতা, সচেতন নাগরিক সমাজ সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল বলেন, নদী দূষণ করা হচ্ছে কিন্তু সিটি কর্পোরেশন কিছু বলছে না। বাতাসে দুর্গন্ধ। আমরা রাতে ঘুমাতে পারছি না।
বালু নদী মোর্চা নেতা এবং বারোগ্রাম উন্নয়ন সংস্থার সদস্য জান্নাতি আক্তার রুমা বলেন, দাশেরকান্দিতে একটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হয়েছে কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। জিরানি-দেবদুলাই-নড়াই খালের পানিতে দুর্গন্ধ। আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবো যতদিন আমাদের নদী দূষণমুক্ত না হয়।
বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চার নেতা মানিক ব্যাপারী বলেন, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন দেখেছি বুড়িগঙ্গা অনেক বড় ছিল। হাজারিবাগের ট্যানারি আগে বুড়িগঙ্গা দূষণ করতো তারপর সেটা হেমায়েতপুরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর এখন ধ্বলেশ্বরীতে দষূণ ছড়াচ্ছে। নদীর মুখ বন্ধ করে পাওয়ার প্ল্যান্ট করে বুড়িগঙ্গা নদীকে ধ্বংস করা হচ্ছে। ট্যানারির পানি যাতে নদীতে না পড়ে তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
তুরাগ নদী মোর্চার ঘাট শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আমজাদ আলী লাল বলেন, তুরাগ এখন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। এটাকে বাঁচাতে কাজ করতে হবে। আমরা অনেক সমস্যার মধ্যে আছি।
তুরাগ নদী মোর্চার নিত্য রাজবংশী বলেন, আমরা তুরাগপাড়ের মানুষেরা অনেক সমস্যার মধ্যে থাকি। আমাদের নদী মরে যাচ্ছে। আমরা গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সহযোগিতা চাই।
এসময় রাজনৈতিক দলসমূহকে ঢাকা এবং সারাদেশের নদী রক্ষায় তাদের রাজনৈতিক নির্বাচনী ইশতেহারের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নাগরিক সংলাপে ঢাকা শহরের আশেপাশের নদীর দূষণ ও দখল মুক্ত করে নদীর প্রাণ ফিরিয়ে এনে ঢাকার পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখার জন্য সকল গণমাধ্যম এবং পরিবেশ সাংবাদিকদের সমন্বিত পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়।